ইয়াছিন আলী খান
ভাষা আল্লাহর এক অনুপম নিদর্শন। বর্ণ, শব্দ, বাক্য, উচ্চারণে নানা বৈচিত্র্য বিদ্যমান। যা মুসলমানের জন্য শিক্ষণীয়। ভাষায় আল্লাহর সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘এবং তার নির্দেশনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। (সুরা রুম-২২)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘দয়াময় আল্লাহ, শিক্ষা দিয়েছেন কুরআন। সৃজন করেছেন মানুষ। শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা। (সুরা আর-রহমান, ১-৪)।
আমাদের মহানবির (সা.) ভাষা ছিল সর্বাধিক সুফলিত। তিনি বলতেন, ‘আরবদের মধ্যে আমার ভাষা সর্বাধিক সুফলিত। তোমাদের চেয়েও আমার ভাষা অধিকতর মার্জিত ও সুফলিত। তাই মাতৃভাষার চর্চা, বিশুদ্বভাবে বলা রাসুলের (সা.) সুন্নত।’ ইসলামের প্রসারে, দীনের দাওয়াতের অন্যতম মাধ্যম ভাষা। সুন্দর, শুদ্ধ ভাষায় মানুষকে বোঝানো সম্ভব। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে বিজ্ঞানসম্মত ও উত্তম ভাষণ দ্বারা আহ্বান করো এবং তাদের সাথে সদ্ভাবে আলোচনা করো।’ (সুরা নাহল-১২৫)।
স্বজাতির ভাষা যা; সে ভাষায় ভাষাভাষি করে আল্লাহপাক রাসুল পাঠিয়েছেন। এতেই বোঝা যায়, মাতৃভাষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসুলকেই তার স্বজাতির ভাষাভাষি করে পাঠিয়েছি তাদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সুরা ইবরাহীম, আয়াত-৪)।
আরও পড়ুন: কোরআনুল কারিম হিফজ করার ফজিলত,
হজরত ঈসার (আ.) ওপর ইনজিল কিতাব তার মাতৃভাষা হিব্রুতে নাজিল হয়েছিল। তাওরাত সুরিয়ানি ভাষায় নাজিল হয়। সুরিয়ানি ছিল হজরত মুসার (আ.) মাতৃভাষা। শুধু মাতৃভাষা নয়, অন্য ভাষা শেখা ইসলামে নিষিদ্ধ নয়। প্রখ্যাত সাহাবি হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত আনসারি (রা.) ইয়াহুদি, খ্রিষ্টানদের ভাষা শিখেছেন। তাকে দিয়ে রাসুল (সা.) ইয়াহুদি, খ্রিষ্টানদের চিঠি লেখাতেন। আবার ইয়াহুদি, খ্রিষ্টানদের চিঠি তিনি পড়ে শোনাতেন। (বুখারি-২৬৩১)।
দ্বীনের দাওয়াতের জন্য ভাষা শিক্ষা জরুরি। মুসা (আ.) তার ভাষিক জড়তা দূর করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। ‘হে আমার রব, আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। হে আমার রব, আমার জিহ্বা থেকে জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে।’ (সুরা ত্বহা-২৫-২৮)।
হজরত হারুন (আ.) খুব সুন্দর স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন। মানুষকে বোঝাতে পারতেন। হয়তো সে কারণে মুসা (আ.) তাকে সঙ্গী হিসেবে আল্লাহর কাছে চাইলেন। যখন তিনি ফেরাউনকে ইসলামের দাওয়াত দিতে যান। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে প্রভু, আমার ভাই হারুন আমার চেয়ে সুন্দর ও স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারে। সুতরাং তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন।’ (সুরা ক্বাসাস-৩৪)। খারাপ, কদর্য ভাষা মুনাফিকের লক্ষণ। তারা যখন ঝগড়া-বিবাদ করে; তখন কদর্য ভাষা ব্যবহার করে।
আরও পড়ুন: নবিজির (সা.) বিশেষ কিছু অনুসরণীয় গুণ,
হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যখন সে বিবাদে লিপ্ত হয়, সীমালঙ্ঘন করে কদর্য ভাষা ব্যবহার করে।’ (বুখারি-২৩২৭)। কারো সঙ্গে মতের অমিল হতেই পারে। তাই বলে নোংরা ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। কদর্য ভাষায় আক্রমণ করা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষেধ। এটি কোনো মুমিনের কাজ হতে পারে না। হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিন কখনো দোষারোপকারী, অভিশাপদাতা, অশ্লীলভাষি ও গালাগালকারী হয় না।’ (তিরমিজি-২০৪৩)।
মুসলিমদের গালি দেওয়া স্পষ্ট ফাসেকি কাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি (আল্লাহর অবাধ্য আচরণ) এবং তার সঙ্গে লড়াই-ঝগড়া করা কুফরি।’ (বুখারি-৬০৪৫, ৭০৭৬; তিরমিজি-১৯৮৩)। যত যা-ই হোক, ভাষা সংযত রাখতে হবে। এমন না যে, নোংরা ভাষায় কথা বললে আপনার মর্যাদা বাড়বে। তর্কে জিতবেন। বরং খারাপ ভাষা আপনার মর্যাদা কমিয়ে দিতে পারে।
ফেব্রুয়ারি মাস এলেই নয়, সারাবছর মাতৃভাষার চর্চা বাঞ্ছনীয়। মাতৃভাষার চর্চা অবশ্যই ইসলাম সমর্থিত একটি ভালো কাজ। তাই ঘরে-বাইরে সর্বত্র ভাষার ব্যবহারে যত্নবান হওয়া সময়ের দাবি।