মানিকগঞ্জ থেকে মো. নজরুল ইসলাম:
”জৈব কৃষি চর্চা করি, কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষা করি”। সব সাধকের বড় সাধক আমার দেশের চাষা, দেশ মাতারই মুক্তিকামী দেশের সে যে আশা। এই কথাগুলা বাংলাদেশের কৃষি তথা মাটির ক্ষেত্রে পরম সত্য। কারণ, গত কয়েক যুগে আমাদের জনসংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে,তাই বাড়তি খাদ্য চাহিদা পুরনে আধুনিক কৃষি বিজ্ঞানীরা উদ্বিগ্ন হয়ে কাজ করলেন এবং সফল হলেন। এই কাজে প্রধান ভুমিকা ছিল আমাদের দেশের মাটি। সুজলা সুফলা উর্বর মাটি অকৃপণ হাতে ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত ফসল ফলিয়ে যাচ্ছে। যেখানেই বীজ ছিটানো হয়, সেখানেই যেন সোনা ফলে। আধুনিক প্রযুক্তি, বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের নতুন নতুন গবেষণা আর আবিষ্কারে অধিক ফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবিত হচ্ছে। আমাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। কিন্তু কৃষক ফসলের ন্যয্য মূল্য না পেলেও এতসব প্রাপ্তি আর সম্ভাবনার পরও আমরা সবাই একটা বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন, তা হলো বাজার থেকে যে ফসল আমরা কিনে আনছি, তা সম্পূর্ণ নিরাপদ কি!
অনেকেই আজকাল ‘বিষমুক্ত সবজি’ কথাটি ব্যবহার করেন। ‘বিষ’ কথাটি শুনলেই আমাদের বুকের মধ্যে আতকে ওঠে। বাজার থেকে সবজি কিনে খাচ্ছি, তা ‘বিষাক্ত’ হবে না কেন? কিন্তু সত্যিই আজকাল এ বিষয়টি আমাদের সবাইকে ভীষণ ভাবায়। এই বিষাক্ততার অন্যতম কারণ হলো অধিক লাভের আশায় ফসলের খেতে নির্বিচারে রাসায়নিক কীটনাশক-বালাইনাশক ব্যবহার করা, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করা আর সবজিকে টাটকা রাখতে বা দ্রæত ফল পাকানোর জন্য বিষাক্ত ফরমালিন বা ক্যালসিয়াম কার্বাইডের মতো ক্ষতিকর পদার্থ ব্যবহার করা। ‘বালাইনাশক তথা কীটনাশক ব্যবহার ছাড়া ভালো ফলন পাওয়া যায় না’এই বিশ্বাসে চাষিরাও এসবের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। এতে করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, মাটির গুণগতমান নষ্ট হচ্ছে, উদ্ভিদ ফসলে ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়ছে, সৃষ্টি হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যহীনতা।
তবে আশার কথা হলো দিন দিন ঝুঁকিমুক্ত, বিষমুক্ত আর নিরাপদ খাদ্যের দাবি ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। আমাদের সার্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির স্বার্থেই আমাদের এমন প্রযুক্তি গ্রহণ করতে হবে, যা একই সঙ্গে স্থায়িত্বশীল কৃষি ও পরিবেশবান্ধব। এ ক্ষেত্রে ‘জৈব কৃষি’ অর্থাৎ ‘অর্গানিক কৃষি চর্চার কোনো বিকল্প নেই।
আধুনিক কৃষির বীপরিতে দেশে একদল মানুষ এখনো লোকায়ত জ্ঞানের আলোকে জৈব কৃষি চর্চা সবখানে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে নিরলসভাবে। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বরুন্ডি গ্রামের তরুণ কৃষক শহিদুল ইসলাম(৩৩)। তিনি কৃষিভিত্তিক যৌথ পরিবারে সন্তান এবং পড়ালেখার পাশাপাশি কৃষিকাজকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। তাই একাডেমিক শিক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেড়িয়ে উচ্চতর ডিগ্রীর পেছনে না ঘুরে সরকারি আইপিএম ক্লাব ও বেসরকারি সংগঠন বারসিকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় জৈব কৃষির বুনিয়াদী প্রশিক্ষণে উজ্জিবিত হয়ে লোকায়ত পদ্বথিতে জৈব কৃষির পাঠশালায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন।
কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন- আমার পৈত্রিক জমি দুই বিঘা। এর মধ্যেই আমি কৃষি কাজ করি,বিশেষ করে সবজি চাষের ওপর আমার নেশা ও গবেষণা চলছে। প্রথমে এক বিঘা জমিতে মালচিং পদ্বথিতে টমেটো রোপন করে লাভবান হই। তারপর থেকে আমাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তারপর আমি আরো আট বিঘা জমি এক-দুই বছর মেয়াদী বন্ধক নেই। আমার এই কৃষি প্রকল্পে তিনজন কৃষক ও দুইজন কৃষণী প্রায় সারাবছর কাজ করে।
শহিদুল ইসলামের কাছে জান যায়, তিনি ধান চাষে লাভবান না হয়ে সবজি চাষে নামেন। জমিতে বেগুন, আলু, টমেটো, শিম, করল্লা, মিষ্টি কুমড়া, পেঁয়াজ, ডাঁটা ও লাউসহ বিভিন্ন প্রজাতির সবজি চাষ করছেন। দেশি পদ্ধতিতেই সব চাষ করেন। ফলন বাড়াতে মানবদেহের ক্ষতিকারক রাসায়নিক স্যার এবং ওষুধ ব্যবহার করেন না। জৈবসার দিয়েই চাষাবাদ করে থাকেন। ফলনও হয় বেশ। সংসারের চাহিদা মিটিয়ে প্রতি বছর এক থেকে সোয়া লাখ টাকার সবজি বিক্রি করেন শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন এ বছর আমার জমিতে টমেটো,বাধা কপি,ফুল কপি,আলু ও মিস্টি লাউ চাষ করেছি। এখনো বিক্রি শেষ হয়নি। তারপরও ধারনা করছি যে সমস্ত ব্যয় বাদে কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকা লাভ হবে।
কৃষি কাজে আমার প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণের মধ্যে সেচ,স্প্রে মেশিন নিজের থাকলেও একটি পাওয়ার টিলার বা ট্রাক্ট্রর এর খুবই অভাববোধ করছি। নিজের কৃষি উপকরণ থাকলে উৎপাদন ব্যয় অনেকটাই হ্রাস পায়। বর্তমান সময়ে জ¦ালানি তেলের মূল্য বৃদ্বিতে কৃষিতে উৎপাদন ব্যয় ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে অনেকেই কৃষি কাজে বিনিয়োগে সাহস হারাচ্ছেন। কৃষিতে উৎপাদন ব্যয় হ্রাসসহ বিষমুক্ত লাভজন ফসল পেতে আমার প্রস্তাবনা হলো: ফসল অনুযায়ী উপযোগী জমি নির্বাচন করতে হবে। ভূগর্ভস্ত পানির ব্যবহার হ্রাস করতে প্রাকৃতিক পানি ব্যবহার করতে হবে। পানির প্রাকৃতিক উৎস সুরক্ষায় নদী নালা খাল বির সচল রাখতে রাষ্টীয় ব্যবস্থা গ্রহনের দাবি করছি। আমি মৌসুমভিত্তিক সবজি চাষ করে থাকি। অধিক লাভের আশায় মৌসুমি ফসল অমৌসুমে উৎপাদন করলে বেশি লাভ পাওয়া গেলেও এটিও বিষ। এই ধরনের সবজি ফল কোনটিই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কৃষি কাজে বর্তমানে আরেকটি নতুন সমস্য হলো দেশীয় উফশী ও স্থানীয় জাতের বীজের অভাব। সাধরন কৃষকগন বাজারে থেকে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির বীজ ক্রয় করে প্রথম বছর ভালো ফলন পেলেও সেখান থেকে বীজ রেখে পরের বছর ফলন কম হয় এবং কোন কোন ক্ষেত্রে বন্ধা হলেও কিছুই করার থাকে না,তখন কৃষকের মাথায় হাত। বহুজাতিক কোম্পানির হাত থেকে আমার আসল বীজ ফিরিয়ে আনতে হবে। তার জন্য কৃষক ভাইদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার, সরকরি নিয়ন্ত্রণে বীজ বিতরনের দাবি নিয়ে আন্দোলন করা দরকার।
তরুণ কৃষক শহিদুল ইসলাম আরে বলেন- আমি জৈব কৃষি চর্চায় আনন্দ খুজে পেয়েছি এবং লাভবান হয়েছি। আমি বলি যে সকল তরুণের লেখাপড়ায় মন বসে না,চাকরি পাচ্ছে না,বিদেশে পাড়ি জমাতে চাচ্ছেন,তাদের নুন্যতম এক বিঘা জমি থাকলে সফলতা আসবেই। তারা সরকারি বেসরকারি জৈব কৃষি চর্চার প্রশিক্ষণ গ্রহন করে কাজ শুরু করলে সফলতা আসবেই। আমিও কৃষির বিভিন্ন পদ্বথির ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে যে সকল