ফিরোজ মাহমুদঃ
যে কোনো নারীর জন্য স্বামীর মৃত্যু খুবই বেদনাদায়ক বিষয়। প্রিয়তম স্বামী হারিয়ে একজন বিধবা যখন অসহায়, তখন সামাজিক কিছু বাধ্যবাধকতা ওই বিধবার জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করে।একজন বিধবা স্বামীকে হারানোর মাধ্যমে তার ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়ে ফেলে, হারিয়ে ফেলে তার সন্তানের বাবাকে। ফলশ্রুতিতে তার উপর সন্তান লালন-
পালনের গুরুদায়িত্ব এসে পড়ে। আর এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে একই সাথে বাবা-মায়ের দায়িত্ব পালন করতে হয়।অনেক বিধবার স্থান স্বামীর বাড়িতে হয় না। তাকে স্বামীর উত্তরাধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। ফলে সে বাধ্য হয়ে বাপ-ভাই কিংবা অন্য আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয়ে থাকে। ইদানিং অবশ্য অনেকে একা থাকেন, কেউ আবার বৃদ্ধাশ্রমে চলে যান। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। স্বামীর বাড়ি হোক আর যেখানেই হোক ও্ বিধবা নারীকে অনেক সময়ই খাওয়ার সময় ডাকা হয় না, নিষিদ্ধ করা হয় পুষ্টিকর খাবার। কাপড় পরিধান থেকে শুরু সাজ-গোজ, খাবার-দাবার ও চলাফেরায় নেমে আসে নানারকম বিধিনিষেধ। যদিও একজন বিধবা তার স্বামীকে হারানোর সাথে সাথে তার একটি পরম আশ্রয়স্থল হারিয়ে ফেলে। ফলে তাকে ভোগ করতে হয় সীমাহীন যন্ত্রণা। তার এ যন্ত্রণা কেবল অর্থনৈতিক নয়; বরং অধিকাংশ সময় এ যন্ত্রণা হয় মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক।জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় পৃথিবীতে ২৮ কোটি বিধবা রয়েছে বলে জানা গেছে। যাদের দশজনে একজন চরম দারিদ্র সীমার নিচে বাস করেন।
ইসলাম বিধবা নারীকে বিবাহ করতে উৎসাহিত করেছে। স্বামীর মৃত্যুর পর পুনরায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া একজন নারীর মানবিক অধিকার। এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- তোমাদরে মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মারা যায় তাদের স্ত্রীদরেকে চারমাস ১০ দিন অপক্ষো করতে হবে। ইদ্দত বা এই নির্ধারিত সময় শেষ হবার পর তারা বিধিমত নিজেদের জন্য কোন কাজ করলে (বিবাহ করলে) তাতে তোমাদের (অভভিাবকদরে) কোন পাপ হবে না। তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সর্ম্পকে সবশিষে অবহতি।” সূরা বাক্বারা আয়াত: ২।
সুতরাং একজন নারীর সতীত্ব রক্ষার্থে কিংবা তার মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতা পূরণের জন্য ইসলাম একজন বিধবাকে পুনরায় বিবাহ করার অনুমতি দিয়েছে। এতে করে তার স্বামীর অপূর্ণতা পূরণ হবে ও তার এতীম সন্তানেরা একজন বাবা পাবে। এক্ষেত্রে একজন পুরুষকে সর্বোচ্চ সতর্কতার পরিচয় দিতে হবে। তার স্ত্রী বিধবা বিধায় কিংবা তার সন্তান তার জন্য সৎ হওয়ায় কোনোভাবেই তাদের সাথে অসদাচরণ করা যাবে না। বরং তাকে তাদেও সাথে এমন আচরণ করতে হবে যাতে করে উক্ত স্ত্রী তার পূর্বের স্বামীর শূণ্যতা ভুলে যায় ও তার সন্তানেরা সত্যিকার অর্থে একজন বাবা খুঁজে পায়। এতে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি একজন বিধবাকে বিবাহ করার সওয়াবের পাশাপাশি এতীমের রক্ষণাবেক্ষণের সওয়াবও লাভ করবে।রাসুলুল্লাহ সা. বলেন- যে ব্যক্তি কোনো বিধবাকে (বিবাহ করে) তার দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করে, তার মর্যাদা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর ন্যায়; অথবা ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে সারারাত নফল সালাত আদায় করে ও সারাদিন রোজা রাখে। (বুখারি)ইসলাম বিধবা নারীকে অবিবাহিত থাকতে নিরুৎসাহিত করে। এর পরও কোনো বিধবা নারী যদি তার সন্তানের জীবন ও ভবিষ্যতের চিন্তা করে নিজের স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দেয় এবং সন্তান প্রতিপালনে সততার সঙ্গে ধৈর্যের পরিচয় দেয়, তবে পরকালে সে পুরস্কৃত হবে।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন—
আমি ও (নিজের যত্ন না নেওয়ায়) চেহারায় দাগ পড়া নারী পরকালে এভাবে থাকব অথবা শাহাদাত ও মধ্যমা আঙুলের চেয়ে বেশি দূরত্ব থাকবে আমাদের মধ্যে। সে হলো সেই নারী যার স্বামী মারা গেছে এবং তার বংশীয় মর্যাদা ও সৌন্দর্য থাকার পরও সে নিজেকে বিরত রাখে এতিম সন্তানদের জন্য—যতক্ষণ না সন্তানরা (স্বাবলম্বী হয়ে) পৃথক হয়ে যায় অথবা মারা যায়।
(সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫২৪৯)যে বিধবার দায়িত্ব গ্রহণ করবে ইসলাম বিধবা নারীর দায়িত্ব গ্রহণকারীর জন্য বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করেছে। নবী (সা.) বলেছেন, ‘বিধবা ও মিসকিনের জন্য খাদ্য জোগাড়ে চেষ্টারত ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো অথবা রাতে সালাতে দণ্ডায়মান ও দিনে সিয়ামকারীর মতো।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : আল্লাহর রাসুল সা. বলেছেন- আমি ও এতীমের রক্ষণাবেক্ষণকারী জান্নাতে এভাবে থাকবো। একথা বলে তিনি সা. তাঁর তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুল উঁচু করে ধরলেন। বুখারি।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের সমাজে বিধবাদের তীর্যক দৃষ্টিতে দেখা হয়। কখনো কখনো তাদের কাছ থেকে তাদের স্বামী কর্তৃক রেখে যাওয়া সম্পত্তি কেড়ে নেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটতে শোনা যায়। অথচ ইসলাম একজন বিধবাকে পুনরায় বিবাহ করা ও তার দেখাশোনার ভার গ্রহণ ব্যাপারে প্রবলভাবে উৎসাহিত করেছে।
বর্তমান অসুস্থ সমাজব্যবস্থা বিধবার অধিকার হরণ করলেও ইসলাম একজন বিধবার ষোল আনা অধিকার নিশ্চিত করেছে। একজন বিধবা তার মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে যথাযথ পরিমাণ সম্পদ পাবে। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- তোমাদরে সন্তান না থাকলে তাদরে জন্য তোমাদের সম্পত্তির এক চর্তুথাংশ, আর তোমাদরে সন্তান থাকলে তাদরে জন্য তোমাদের সম্পত্তির ৮ ভাগরে এক ভাগ। সূরা নিসা, আয়াত ১২।ইসলাম একজন বিধবার জন্য নিরাপদ বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করেছে। স্বামী যদি তার স্ত্রীর জন্য কোনো আবাসস্থল নাও রেখে যায়, মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি থেকে উক্ত বিধবার বাসস্থান নির্মাণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে ইসলাম।
এক কথায়, ইসলাম একজন বিধবাকে বিবাহ করার মাধ্যমে তার সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য ব্যাপক পুরস্কার রেখেছে যা নিঃসন্দেহে একজন সৎকর্মশীল পুরুষকে উক্ত কাজে উৎসাহিত করে। একজন পুরুষই যে কেবল এককভাবে এ পুরস্কার লাভ করে তা নয়; বরং একজন বিধবাকে বিবাহ করার মাধ্যমে সমাজ থেকে অনেক অন্যায়-অনাচার দূরীভূত হয়।