• Home
  • মতামত
  • ১৪’ই ডিসেম্বর–শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে কিছু কথা
Image

১৪’ই ডিসেম্বর–শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস নিয়ে কিছু কথা

ইকবাল আহমেদ লিটন,কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকঃ

একটা দেশের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিতে হলে বেশি কিছু করা লাগে না। শুধু ঐদেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করলেই চলে। পাকিস্তান যখন বুঝতে পেরেছে যুদ্ধে তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তখন তারা সেই ঘৃণ্য কর্মকান্ডটিই ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ যাতে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারে ১৯৭১ সালের এই দিনে সেই কাজটিই করেছে তারা। কতটা হীন মন মানসিকতার হলে তারা এই কাজটি করতে পারে? দুঃখটা লাগে তখনি যখন দেখি আমাদের বাংলাদেশেরই লোক মুসলমানের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে কথা বলে। দুঃখটা ঠিক তখনি লাগে যখন এই দেশের মানুষের মুখে শুনি বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে থাকলেই ভাল হতো। দোষটা আসলে ওদের না। পাকিস্তানিরা এই দেশের দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জত হরণ করে জন্ম দিয়ে গেছে তাদেরই ঔরসজাত সন্তান। যার কারনে তাদের পক্ষে কথা বলার মত লোকের অভাব নাই। পাকিস্তানকে মুসলিম দেশ বলে আপনারা যতই পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করেন না কেন, আমি বলবো তারা হলো আমার আপনার মা বোনের ধর্ষক। তারা লাখো নিরপরাধ বাঙালিদের হত্যাকারী। তাই আমার বিবেক আমাকে পাকিস্তানের কোন কাজে সমর্থন দিতে বাধা দেয়। তারা বরাবরই হলো মুসলিম জাতির কলঙ্ক।

অনেক আগেকার একজন ইমাম সাহেবের কাছে শোনা, ৭১ এ তিনি মীরহাজিরবাগের বর্তমান পাইপলাইনের গলিতে ইমামতি করতেন। ঢাকায় যখন পুরোদমে মারামরি, গোলাগোলি, তখন তিনি নিজের জীবন বাচাঁতে ঢাকার আশেপাশের কোনো গ্রামের দিকে ছুটতে লাগলেন। উনার কথার এই পর্যায়ে আমি একটু ধাক্কা খেলাম। হুজুর, আপনি ভাগছিলেন? কেন ? আপনার দাড়ি আছিলো না ঐ সময়? হুজুর হাসে। আমার দিকে তাকায় আর শুধু হাসে। বলে “ তোমারে কে কইলো দাড়ি দেখলে ছাইড়া দিছে? আমার চোক্ষের সামনে সাদা সফেদ দাড়িওয়ালারে জবাই করছে, আমার সামনে মাদ্রাসার পোলাপানেরে গুলি কইরা মারছে। আমি অবাক হই। আমি তখন জানতাম মুক্তিযুদ্ধে হুজুরেরা দেশ থিকা হিন্দু খেদাও আর ভারতীয় মুক্তি খেদাও করছে। হুজুর মনে হয় কিছু বুঝে, আমারে বলে বড় হও সব তখন বুঝবা। বড় হইতে থাকি, কিছু কিছু বুঝতে থাকি। না, ৭১ এ কোনো ধর্মযুদ্ধ হয় নাই। ৭১ এ পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদেরকে আমাদের অধিকার বঞ্চিত করতে চেয়েছিলো, আর তদানিন্তন পূর্ব-পাকিস্তান আমার, আমাদের বাংলাদেশ চেয়েছিলো স্বাধীকার। পাকিস্তানিদের থেকে মুক্তির পাশাপাশি ছিলো স্বায়ত্বশাসনের জন্যে আন্দোলন। কিন্তু কিছু মানুষ এর বিরোধিতা করছে। তাদের বিরোধিতার কারণ হিসেবে তারা ঐক্যবদ্ধ ইসলামিক রাষ্ট্রের কথা বলে। তারা বলে সে সময় তাদের বিরোধিতার কারণ ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ থেকে মুসলমান রাষ্ট্র পূর্ব-পাকিস্তান কে রক্ষার কথা। কিন্তু তারা আদৌ কি সে কথা বিশ্বাস করতো? যদি তা’ই হয়, তবে বিজয়ের ঠিক দুদিন আগে তাদের পরাজয় নিশ্চিত জানার অল্প সময়ের ভিতর ১৪ ই ডিসেম্বর পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃন্যতম এই অপরাধটা তাদের করার প্রয়োজন কেনো পড়লো? ২৫শে মার্চ কালো রাত থেকেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এদেশের শিক্ষক-ছাত্রদের হত্যা শুরু করে। ঐ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হয়। পাকি বাহিনী তো এদেশে নতুন ছিলো। সে সময় তাদের ইন্টেলিজেন্স নিশ্চয় তাদের তো সবাইকে চেনার কথা ছিলো না, যে এদেশীয় কারো সাহায্য ছাড়া তারা জানতে পারতো কাদের মারতে হবে আর কাদের দলে ভিড়াতে হবে। সম্পূর্ণ ১৯৭১ সাল জুড়ে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনী, আল-বদর বাহিনী, আল শামস বাহিনী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের উপর নিপীড়ন চালায়। যুদ্ধের প্রথমদিকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের উপর সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন চলে যুদ্ধের শেষ কয়েকটি দিনে। শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, চিত্রশিল্পী, প্রকোশলী ও লেখকদের তালিকা প্রস্তুত করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী। আর এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সহযোগীতা করে আল-বদর বাহিনী, আল শামস বাহিনী। সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের উপর গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী । ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের উপর এক জরিপে দেখা যায় : শিক্ষক-৯৯০ জন। সাংবাদিক-১৩ জন। চিকিৎসক-৫০ জন। আইনজীবী-৫০ জন।
লেখক, প্রকোশলীসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবী-১৮ জন। স্বাধীনতার মাত্র ২ দিন আগে এদের’কে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয়। এই ৯৯০ জন শিক্ষক বা ৫০ জন সাংবাদিকের মাঝে কয়জন হিন্দু ছিলো বলেন তো। আসলে তারা প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠেছিলো, আর এই প্রতিশোধপরায়নতায় তাদের হিংস্রতাকে বাহবা দিয়েছে যারা, যারা লিষ্ট করে বলেছে এদের মারলে শালারা মুক্তি বুঝতে পারবে ঠেলাটা। আমরা কেনো তাদের জন্যে চোখের পানি ফেলি আজো? কেনো তাদের বিচারের কথা শুনলে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে বলে রব তুলি? আফসোস, আমাদের পূর্বপুরুষেরা কি এই সকল জারজদের জন্যে যুদ্ধ করেছিলেন? যারা কি না বলে হিন্দু হত্যা করেছিলো। খুব কষ্ট লাগে যাঁদের ত্যাগের জন্য আজ আমরা স্বাধীন, তাঁদের হত্যার বিচার আমরা করতে পারিনি।

এখন আসা যাক মূল বিষয়ে: ঘুরেফিরে বছর পেরিয়ে আবার এসেছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। যাইহোক, দিবসটি উপলক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা পৃথক বাণী দিবেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকেন। এবারও রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতারা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিভিন্ন দল ও সংগঠন শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পৃথকভাবে ফুল দিয়ে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে। গণহত্যার শিকার মানুষের নীরব আকুতিতে ধ্বনিত হচ্ছে সত্য ও ন্যায়ের বাণী। কালের এই ঘণ্টাধ্বনি বাজছে আপনার-আমার সবার জন্য।’ আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে সময় এসেছে বুকে হাত দিয়ে তাঁদের নামে শপথ নেওয়ার, এত প্রাণের বিনিময়ে যে দেশ আমরা পেয়েছি, বিশ্বসভায় আমরা তাকে সবার ওপরে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাবই। সাক্ষী বাংলার রক্তে ভেজা মাটি, সাক্ষী আকাশের চন্দ্রতারা, ভুলিনি শহীদের কোনো স্মৃতি, ভুলব না কিছুই আমরা। অনুমান করা যায়, যেসব গাড়ি প্রস্তুত ছিল তা বেসামরিক যান, আর তাই পিলখানার ভেতর এসব গাড়ি ফরমানের বিশেষভাবে নজরে পড়েছিল। গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত যখন হয়েছে, এর অর্থ একটি তালিকাও নিশ্চয় তৈরি হয়েছিল। এই তালিকা প্রসঙ্গে যে প্রশ্ন হামুদুর রহমান কমিশন করেনি, তা হলো, কেন মেজর জেনারেল ফরমান আলীর ডেস্ক ক্যালেন্ডারে বুদ্ধিজীবীদের নাম তাঁর নিজের হাতে লেখা ছিল। বোঝা যায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পৃক্তি ছিল রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল জামশেদের। উল্লেখ্য, রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়েছিল আনুষ্ঠানিকভাবে অর্ডিন্যান্স জারি করে এবং বেসামরিক প্রশাসন এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। অন্যদিকে ঘাতক আল-বদর বাহিনী গঠন করা হয়েছিল রাজনৈতিক নেতৃত্ব দ্বারা এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন গভর্নর নয়, গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য তিনি নিয়োগ করেছিলেন ফ্যাসিস্টদের স্টর্ম ট্রুপার বা এসএস বাহিনীর মতো রাজনৈতিক দীক্ষাপ্রাপ্ত ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাদের। আর এই কাজের লজিস্টিক সমর্থন প্রদান করেন মেজর জেনারেল জামশেদ। বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের জন্য তাই প্রত্যক্ষভাবে দায়ী ইস্টার্ন কম্যান্ডের নেতৃবর্গ এবং তাদের এ-দেশীয় দোসর ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতৃত্ব। এসব বিষয়ে অধিকতর তথ্যানুসন্ধান এখন জরুরি হয়ে উঠেছে, কেননা গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচারের যে প্রক্রিয়া অচিরেই শেষ প্রায়, সেখানে এই হত্যাকাণ্ড বড়ভাবে উঠে আসবে এবং যথাসম্ভব তথ্য আহরণ বিশেষ জরুরি। পরিশেষে: ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক পাকিস্তানি জবানিতে বাস্তবের নানা স্বীকৃতি প্রকাশ পাচ্ছে। ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতার রাজনীতি মানবতাকে কোন অতল অন্ধকারে ঠেলে দেয়, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড তার পরিপ্রকাশক। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় যখন নিশ্চিত, ঠিক তখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের রাতের আঁধারে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। আমাদের প্রয়োজন এ সম্পর্কে সবিস্তার তথ্য সংগ্রহ, দোষীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এবং উদার, অসাম্প্রদায়িক, সহিষ্ণু সমাজ প্রতিষ্ঠার সব প্রয়াস বেগবান করা। তবেই তো নিবেদিত হবে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধাঞ্জলি।

-লেখকঃ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, সদস্য সচিব আয়ারল্যান্ড আওয়ামী লীগ, ইকবাল আহমেদ লিটন,।

Releated Posts

এক সময়ের কাচারি বাড়ী যা কেবলই অতীত স্মৃতি 

লেখকঃএস এম ফিরোজ আহাম্মদ একসময় গ্রামীণ জনপদের অধিকাংশ গৃহস্থের বাড়িতেই ছিল কাচারি ঘর। কাচারি ঘর ছিলো গ্রাম বাংলার…

ByByFeroz Ahmedজানু ৮, ২০২৫

৪ ঠা জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ও কিছু কথা

লেখক -ইকবাল আহমেদ লিটন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হাটি হাটি পা…

ByByFeroz Ahmedজানু ৪, ২০২৫

বিএনপির তিন সংগঠনের লংমার্চ বুধবার

অভিযোগ বার্তা ডেস্কঃ ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন অভিমুখে প্রতিবাদ পদযাত্রা ও স্মারকলিপি দেওয়ার পর ঢাকা টু আখাউড়া লংমার্চ কর্মসূচি…

ByByFeroz Ahmedডিসে ৯, ২০২৪

আওয়ামীলীগ সরকারের পতন ও একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

লেখক ও কলামিস্টঃ ইকবাল আহমেদ লিটন কোটা-আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি— এই তথ্য আবিষ্কৃত হওয়ায়…

ByByFeroz Ahmedডিসে ৮, ২০২৪

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Design & Developed by BD IT HOST