ইকবাল আহমেদ লিটন: সবুজ শ্যমল ছায়া সুনিবিড় শান্তির স্নিগ্ধতায় বিস্তৃর্ন মাঠের পরেই চারপাশে বড় বড় গাছে ঘেরা সবুজ বেষ্টনির সারিসারি বাড়ীর সমারহে বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত সাজানো গোছানো। বাংলার গ্রামে ধনী দরীদ্র সকলে মিলে মিশে থাকা আত্মিয়ের বন্ধন যেন পুর্ব পুরুষের। হাঁস মুরগী গরু ছাগলের বন্ধন মুক্তির কোলাহলের স্পন্ধিত প্রেরনাই নারীর নিত্যদিনের কর্মশুরু। পুরুষ মানুষের তেজদীপ্ত নিরন্তর ছুটে চলা মাটির সাথে যুদ্ধ করেই সোনা ফলানোর নিত্যকার লড়াই। ফসলের আগমন বাংলার গ্রামজুড়ে আনন্দের ঢেউ। নবান্নের অন্ন প্রসাদে সকলেই অংশীদার। মিলে মিশে আনন্দের ভাগাভাগি বাংলার গ্রামের সকলের। কেউ কৃষি শ্রমিক আর মালিকের যৌথ শ্রম ঘামেই বাংলার গ্রামের শশ্য উৎপাদন, বিপনন। মালিকের ঘরে গোলা ভর্তি শশ্যই গরীবের সান্তনা। দুর্দিনে সকলে আমরা সকলের তরে প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। খরা, বন্যা, ডাইরীয়া ও বসন্ত এমনকি করোনা মোহামারীতে গ্রাম ভীত হয়ে বিসন্নতায় স্তব্দ থাকে। মৃত্যু শোক নীজেদের চোখের পানি নীজেরাই মুছে দিয়ে আবার নুতন জীবন শুরু করি। ধর্মীয় উৎসব, সামাজীক আনন্দ মেলা, মিলে মিশে বাংলার সকলেই মিলিত হয়ে একত্রে উপভোগ করে। গরুদৌড়, হাডুডু, গোল্লাসুট, ফুটবল, ঘুড়ি উড়া, জারী গান, কবি গান, পার্বন, বৈশাখী মেলা, চৈত্র সংক্রান্তি, মিলাদুন্নবী, সবেবরাত, ঈদ, পূঁজা বাংলার রুপের জীবনকে প্রাচ্যাত্তের সভ্যতার আনন্দকে হার মানায়ে নবদিগন্তের প্রেরনায় মুখরিত করে রাখে বাংলার গ্রামের মানুষের সহজ সরল জীবনকে। স্বল্প চাহিদা, সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, স্বাধীন ধর্ম পালন, নুন্যতম চিকিৎসা সেবা, সন্তানদের লেখাপড়া, অসাম্প্রদায়ীক চেতনায় বিকশিত জীবন বোধই গ্রামের মানুষের জীবনের দাবী। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ন চাওয়া নিরাপত্তার চাদরে আবৃত এক সুন্দর জীবন। পাখির কন্ঠে গান, স্কুল ছুটির কোলাহল, দুর হাটের শব্দ, রাখালের মেঠো সূর, মাঝির উজানের ভাটিয়ালী গান, গাছের ছায়ায় কাজের অবসরে বাঁসির সূর, লালপাট্টার শাড়ী পড়া পল্লি বধূর ঘোমটা দেওয়া লাজুক চাহনী, সন্ধার আগমনে চুটিয়ে আড্ডা মারা গ্রামীণ জীবনের এক অপরুপ অনুভুতির এক স্বর্গভুমি। এর মধ্যে কোন রাজনীতি নেই। কালের পরিক্রমায় ছায়া-সুনিবিড়, শান্তির বিস্তৃর্ন মায়ের কোলে রাজনীতির নামে অপরাজনীতির এক বিষবাস্প ছড়িয়ে পড়েছিল। দীর্ঘ ২১বছর দেশ ও জাতিকে বিএনপি – জামায়াতিরা উল্টোদিকে নিয়ে গিয়েছিল, ইতিহাস বিকৃতির মত জঘন্যতম কাজও করেছিল। গ্রামের মানুষের এই বিভাজন কাম্য ছিল না। ধর্মীয় মতভিন্নতা হাজার বছরেও গ্রামীন জনপদের মানুষের ঐক্য বিনষ্ট করতে পারেনি। পাকিস্থান-ভারত নামক নুতন রাষ্ট্রের গর্ভপাতের সময়ে কোন এক রাজনৈতিক নেতা, ইতিহাসের অবৈধ সন্তান, হিন্দু, মুসলিম ধর্মীয় জাতীস্বত্বার ভিতরে দাঙ্গা বাধিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রানহানি ঘটায়েছিলেন। ইতিহাসের ক্ষত শুকাতে দীর্ঘদিন কেটে যায় গ্রামীন মানুষের। শরীরের ক্ষত স্থানের দগ্ধ পোড়া ক্ষত মনকে ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দিয়ে বাঙালি মুসলমান, বাঙালি হিন্দু বাঙালি উপজাতী, আবার ইতিহাসের এক ক্ষনজন্মা মহানায়কের উদাত্ত আহবানে ঐক্যের কাতারে সামিল হয়ে ছিনিয়ে এনেছে নুতন ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনার পলি বিধৌত জনপদের আবাস ভূমি সোনার বাংলাদেশ। পূনরায় ঐক্য আর ভালোবাসায় স্থাপিত হয়েছে সোনার বাংলাদেশের বিস্তৃর্ন গ্রামীন জনপদ। বাংলাদেশই গ্রাম, গ্রামই বাংলাদেশ। রাজনীতির মূল্যবোধ এখনো সম্বৃদ্ধশালী হতে পারে নাই। রাজনীতিবিদরাই তা নষ্ট করে দিয়েছে। বাবা ভাংগা সাইকেল দৌড়াতেন সে ঘরের বেকার ছেলে রাজনীতির হাত ধরে দেড় কোটি টাকার গাড়ীর মালিক। দেড় টাকা দিয়ে গুলশান দেড় একর সম্পতি বন্দবস্ত নেওয়া রাজনীতিবিদের হাতে বাংলাদেশ নিরাপদ থাকার কথা নয়। এমন একটি সময়ে গ্রামাঞ্চলে রাজনীতির বিষবাস্প সুড় সুড় করে প্রবেশ করেছে, অপ্রত্যাশিতভাবে। ইতিহাসের সেরা উপহার সোভিয়েত রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রীক দর্শন, প্রতিষ্ঠার সত্তোর বছরের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছে, লেনিন গ্রাদ থেকে লেনিনের ভাস্কার্য়্য নিদারুন অপমানের মধ্য দিয়ে ভেংগে ফেলা হয়েছে। ভারতের পশ্চিম বঙ্গে, গ্রামীন পাঞ্চায়েত নির্বাচনে বামফ্রন্ট ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার কৌশল হিসাবে গ্রামীন জনপদেকে রাজনীতিকরণ করেও রাজনীতির মঞ্চ থেকে বামফ্রন্টকে পালাতে হয়েছে। পরীক্ষামূলক সকল দর্শনই ঝুকিপূর্ন। সমকালীন মার্কা ভিত্তিক নির্বাচনে রাজনীতির মাঠে অনৈতিক লোকের আগমন ঘটেছে। টাকা দিয়ে নমিনেশন কিনে গনতন্ত্রের প্রকৃত মালিক জনগনকে ভুলে দলতন্ত্রের মালিক দুর্বৃত্ত নেতার পদাতলে ঠাঁই নিয়েছে, তারা বেশীর ভাগই গণবিরোধী। গ্রামীন জনপদে আজ সামাজিক মূল্যবোধের কোন কোন জয়গায় অজ্ঞরা বিজ্ঞদেরকে আদেশ দেন, মুর্খরা জ্ঞানীদের মাঝে জ্ঞান বিতরন করেন, অথর্ব, মাদক, জুয়াড়ী, সমাজ বিরোধীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথে। রাজনীতির লুডু খেলায় সকলে মই বেয়ে মসনদের চূড়ায়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের জন্য সাপ লুডুর খেলাতে সাপের মুখে পড়ার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বিবাহ, ওয়াজ মাহফিলে, মেলা, পর্বনে, সামাজিক উৎসবে এসকল অনির্বাচিত নেতাদের উপস্থিতিতে আনন্দ বিলিন হয়ে যায়, শুধু তাই নয় তাকে প্রধান অতিথী না করলে অনুষ্ঠানই পন্ড হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। এটাই বর্তমান গ্রাম্য পলিটিক্স। সে যাইহোক, গ্রামীন জনপদের হাজার বছরের সাম্যতা (equity) ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা আজ সংকটাপন্ন, আর্থীক সুবিধার বিনিময়ে বিরোধ নিস্পত্তি। জনবান্ধব নীতির পরিবর্তে নিজের তৈরী করা শাসক জাতীয় কঠোর শাসনতন্ত্র, জনগনের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মানুষ নিঃশব্দ বেদনায় ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অপেক্ষার পালা গুনছে। রাস্তা ঘাট কেটে, গাছ পালা কেটে, আগুন, পেট্রোল বোমার নির্মম হত্যা কান্ডের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিপরীত এমন একটি সমাজ ব্যাবস্থা গ্রামীন জনপদে উপস্থাপিত হয়েছে যার কোন সংজ্ঞা নেই। সত্যিকার রাজনীতিবিদরাই ইতিহাসের ক্ষনজন্মা ও মহান পুরুষ। প্রকৃত দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিক নেতা জনগনের মুখের ভাষা, চোখের ভাষা বুজতে পারেন। রাজনীতিতে কৌশল পরিবর্তনে লজ্জার কিছুই নেই।